ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

Daily Inqilab প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর যে জাতীয় ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন জাগ্রত করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তারই আকাক্সিক্ষত ফল বেগম খালেদা জিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁর শাসনামলে প্রসারিত হয় এবং দেশনায়ক তারেক রহমানের আত্মপ্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মে অনুপ্রেরণার শত ধারার উৎসে আজ বিকশিত। বলাবাহুল্য, সৃষ্টিকর্তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন। প্রথম থেকেই বিএনপির লক্ষ্য ছিল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার উত্থান ঘটানো। এগুলোর ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই ১৯ দফার উপরে ভিত্তি করে বিএনপির রাজনীতির মূল নীতি ও আদর্শ প্রসারিত।

২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অবধি বাংলাদেশ নানাভাবে বিভেদে নিমজ্জিত হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা অনৈক্যের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভোট চুরির মচ্ছবের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ব্যর্থ রাষ্টের তকমা পেয়েছে। গণতন্ত্রহীন পরিবেশ ও বাকস্বাধীনতা হরণের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের গণঐক্যের চেতনা গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐক্যকে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখ-তা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত করার মূল মন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্যদিকে এই ঐক্য চেতনাকে টেকসই করার জন্য গ্রহণ করেছিলেন উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক মানবমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের ধারণাকে। ফলে জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রামে-গঞ্জে জনগণকে সচেতন ও সুসংগঠিত করার প্রয়াস এবং আশির দশকজুড়ে সার্বিক উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনা ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও দক্ষতা জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়ায় প্রচেষ্টা থেকে জনজীবনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূচনা ঘটে।

জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন, এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে যেন দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, একটি সু¯পষ্ট ও স্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চিত করা, যার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই তাদের মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবেন। এজন্য তিনি প্রচলন করেন, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কেবল বহুদলীয় গণতন্ত্র কিংবা মানবিক স্বদেশ গড়ে তোলার সদিচ্ছা নয়, জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন, গণনির্বাচিত জাতীয় সংসদের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করতে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য হত্যা, গুম, খুনকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। অথচ প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক গোপন সংগঠনের তৎপরতা এবং কোন সশস্ত্র ক্যাডার, দল বা এজেন্সি গঠনে অস্বীকৃতি জানান ও তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেন। বরং জাতীয় জীবনে মানবমুখী সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন এবং সৃজনশীল উৎপাদনমুখী জীবনবোধ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ছিল তাঁর রাজনীতির অন্যতম দিক। বাস্তবধর্মী কার্যকরী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচারভিত্তিক সুষম অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যাতে সকল বাংলাদেশী নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়, সে ব্যবস্থা করাই ছিল বিএনপির প্রধান বিবেচ্য বিষয় ।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা বিতারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারতের কাছে নতি স্বীকার করার নীতি। এজন্য ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্যকোনো দেশ তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। পক্ষান্তরে আমরা দেখতে পাই, ১৯৭৮ সাল থেকেই জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব, প্রীতি ও সমতা রক্ষা করে এসেছেন । সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে, তৃতীয় বিশ্বের মিত্র রাষ্ট্রসমূহের সাথে এবং ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রীতি ও সখ্য স¤পর্ক সুসংহত এবং সুদৃঢ় করেছেন। ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রীতি ও সখ্য স¤পর্ক রক্ষার কারণ হলো, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী জনগণের ধর্ম ইসলাম। মনে রাখা দরকার, ভারতের কাছে নতজানু না হয়েও সকল সম্প্রদায়ের মঙ্গল কামনার নীতিতে অটল ছিলেন জিয়াউর রহমান। মুসলিমদের বাইরে অন্যান্যদের ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দান করে বাংলাদেশের জনগণের যুগপ্রাচীন মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করা এবং অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণ ও বৃহত্তর জাতীয় জীবনে তাদের অধিকতর সুবিধা ও অংশগ্রহণের সুযোগের যথাযথ ব্যবস্থা করার নীতি ছিল তাঁর।

আজ ২০২৪ সালে গণ-আন্দোলনের পর যে যুবসমাজের জন্য আমরা গৌরব বোধ করছি, সেই যুবসমাজ নিয়ে জিয়াউর রহমানও চিন্তা করে গেছেন। নারী-পুরুষ সকল স্তরের মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য বাস্তবধর্মী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম ব্যবস্থাপনা স¤পর্ক স্থাপন এবং সুষ্ঠু শ্রমনীতির মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। এমনকি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বাংলাদেশের ক্রীড়া সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে কাজ করে গেছেন। বলা যায়, আজকের যে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে তার বেড়ে উঠা এবং বিকশিত হওয়ার পিছনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি মিশে আছেন বাংলার শস্য-শ্যামল মৃত্তিকার প্রতিটা অলিন্দে। এক কথায় দেশের শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও মানবস¤পদ উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জিয়াউর রহমান আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।

২.
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ছিল দৃশ্যত অগণতান্ত্রিক উপাদানের পাশাপাশি কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উপস্থিতি এবং শাসন পরিচালনার জন্যে শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভরশীল একটি অকেজো রাষ্ট্র। গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রের আনূকূল্যে ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে নতুন ধনিক শ্রেণি। গড়ে ওঠা এই শ্রেণির মধ্যে জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার প্রচলনের আকাক্সক্ষার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত এক নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশ বারবার রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি পড়েছে। ১৯৯১ সালে দেশে নির্বাচিত বেসামরিক শাসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চালুর পরে আশা করা হয়েছিলো যে, এই ধরনের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটবে। কিন্তু তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিশেষত ২০০৯ থেকে ২০২৪ অবধি নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। গবেষকদের লেখায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত দেখা যায়। একজন গবেষক বলেছেন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কেবল জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়নি, তা তৈরি করেছিলো একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় ব্যবস্থার পর শহীদ জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা কর্তৃত্ববাদী ধরনের শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল।

নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান; কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচনের ওপরে অতিরিক্ত জোর দেয়াকে কেউ কেউ ‘ফ্যালাসি অফ ইলেক্টোরালইজ’ বলে বর্ণনা করেছেন । ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় স্যামুয়েল হান্টিংটন দেখান, শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসে তিন দফা গণতন্ত্রের প্রসার হয়েছে; একে তিনি আখ্যায়িত করেন, ‘গণতন্ত্রের তিন ঢেউ’ (হান্টিংটন ১৯৯১) বলে। তিনি বলেন, প্রতিটি ঢেউয়ের পরেই এসেছে ভাটার টান। প্রথম ঢেউয়ের ঘটনা ১৮২৬ থেকে ১৯২৬ সাল। দ্বিতীয় ঢেউ দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যার শেষ হয়েছে ১৯৬২ সালে। তৃতীয় ঢেউয়ের সূচনা হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৯১ সালে তাঁর গবেষণার শেষে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে খুব শিগগির ভাটার টান আসবে। তাঁর ‘তিন ঢেউ তত্ত্বে’র সমর্থন পাওয়া যায় তথ্যের মধ্যেই। ১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর মোট দেশের এক-চতুর্থাংশ ছিল গণতান্ত্রিক, ১৯৮০ সালে তা দাঁড়ায় এক-তৃতীয়াংশে এবং ১৯৯২ সালে প্রায় অর্ধেকে। নব্বইয়ের দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে একদলীয় শাসনের অবসান থেকে এটাই বোঝা যায় যে, এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। অনেক দেশেই বড়জোর নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু এর বাইরে গণতন্ত্রের আর কোনো দিকই বিকশিত হয়নি। তবে উত্তরণের পথে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশেষভাবে বিবেচ্য হয়েছে।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পরে যে ব্যবস্থা তৈরি হয় তাঁকে নির্বাচনী গণতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়। এই ধরনের ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে- প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, বহু দলের উপস্থিতি, সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার, নিয়মিত গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে বড় ধরনের জালিয়াতির অনুপস্থিত এবং যাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে; যেখানে গণমাধ্যম এবং নিয়ন্ত্রণহীন নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বড় দলগুলোর ভোটারদের কাছে যাবার সুযোগ আছে (ফ্রিডম হাউস ২০১২) প্রভৃতি। এই ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে অনেক ক্ষমতা অর্পণ করে। কিন্তু ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের সুযোগ থাকলেও খালেদা জিয়া সে সুযোগ ব্যবহার করেননি। বরং সাংবিধানিক বিধিবিধান, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন) গঠনে তাঁর সরকার মনোযোগী হয়ে উঠে। দলের ভেতরে গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় স¤পদ ব্যবহার করে দল ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার বদলে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রধান হয়ে উঠেছিল তাঁর আমলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কারণে যে, ক্ষমতাসীনদের কাজের বৈধতা তৈরি হয় একমাত্র নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই, সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হতে হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর, বিশেষ করে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর, বাংলাদেশে নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। অন্যান্য দেশে বিরাজমান এই ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে এন্ড্রিয়াস স্যাডলার বলেছেন, এই ব্যবস্থায় যা চলে তা বহুদলীয় রাজনীতির খেলা এবং নির্বাচন গণতন্ত্রের নয়, কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয় (স্যাডলার ২০০৬)। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এই ধরনের ব্যবস্থা সহজেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেই তা ভিন্ন হতো কিনা, কিংবা এর কারণ ২০১৫ সালের শুরুতে বিএনপি’র আন্দোলন কিনা সেটা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই ¯পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে আর কোনভাবেই রাজনীতিতে জায়গা দিতে আগ্রহী নয়। ২০১৫ সালে ১ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘দেয়ার ক্যান বি অনলি ওয়ান’ (কেবল এক পক্ষই থাকতে পারবে) শিরোনামের এক নিবন্ধে জাফর সোবহান সু¯পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গেম প্ল্যান খুব ¯পষ্ট। আগামী বছরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা খুব সোজাসাপ্টা : চেপে ধরে বিএনপির প্রাণবায়ু বের করে ফেলা অব্যাহত রাখা। (সোবহান ২০১৫)

গবেষকের একটি মন্তব্য হচ্ছে, ১৯৮২ সালের পর থেকে এই দুই দলের মধ্যে যে অলিখিত চুক্তি বা সমঝোতা ছিলো, তা ছিলো কার্যত সেনা-আমলাতন্ত্রের বিপরীতে বেসামরিক রাজনৈতিক দলের শাসন প্রতিষ্ঠার। ২০০৯ সালের পরে সেটার আর কোনো তাগিদ থাকেনি। তদুপরি যেকোনো হাইব্রিড রেজিম অবশ্যই নির্বাচন করতে চায়, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল কখনো চায় না যে, এমন প্রতিপক্ষ উপস্থিত থাকুক, যা তাকে পরাজিত করার সম্ভাবনা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরে এমন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে যেখানে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হবেন। বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের ইতিহাসই কেবল সেই সাক্ষ্যই দেয় না, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও তাই বলে।’ একতরফা নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের বৈধতা প্রদান করে, ফলে তাঁরা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। কেউ কেউ মনে করেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ তৈরি, জনস¤পৃক্ততা বৃদ্ধি করে গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করেছিল। শক্তি প্রয়োগের এই প্রবণতার ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদেরকে একধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। সেসময় সমর্থক গোষ্ঠীদের গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, মিথ্যা প্রচার, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বিএনপির বিপক্ষে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে এক সময় যে প্রাণবন্ত সিভিল সোসাইটি ছিলো, আজ তার চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। সিভিল সোসাইটিকে দলীয়করণের ধারা ১৯৯৬ সাল থেকে তৈরি করা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক সমাজে জবাবদিহির ব্যবস্থা যেমন সুষ্ঠু, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, তেমনিভাবে আরো দুই ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকে সাংবিধানিকভাবে তৈরি করা ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান (যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন) যারা ক্ষমতাসীনদের ওপরে নজরদারি করতে পারেন, আর হচ্ছে সিভিল সোসাইটি যার মধ্যে আছে স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অন্যান্য ধরনের প্রতিষ্ঠান।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে পরিণত করেছিল। বিশেষত মিডিয়াকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ, স্বতঃপ্রণোদিত সেন্সরশিপ এবং দলীয় আনুগত্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে করে গণমাধ্যমগুলো সমাজের বৃহদাংশের কাছে আবেদন রাখতে ব্যর্থ। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে আওয়ামী রাজনীতিবিদদের আচরণের কারণে দল নির্বিশেষে রাজনীতিকেই দোষারোপ, তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরি এবং এই ধারণা সৃষ্টি যে, তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্য দেশের সার্বিক রাজনীতি থেকে আলাদা সেটা ইচ্ছে করেই তৈরি করা হয়েছিল। সমাজে যারা আছেন তাঁদেরকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা তখন প্রতিদিনের বিষয় ছিল। সে কারণে বিচার বহির্ভূত হত্যা এবং গুমকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছিল।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময় এক ধরনের প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়ন বলা হলেও তার সুফল সকলে সমানভাবে ভোগ করেছে, তা কিন্তু নয়। তদুপরি এই ধরনের প্রবৃদ্ধি সমাজের শ্রেণিবিন্যাস বদলে দেয় এবং তার প্রভাব পরে রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের সময় বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত রাখা অর্থের পরিমাণ, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের সেকেন্ড হোমের সংখ্যা এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) তৈরি করা হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ এসবই বাংলাদেশে বিত্তবানদের সংখ্যা এবং স¤পদের প্রমাণ দেয়। এই অবস্থা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, এই প্রবৃদ্ধির সুবিধা কারা ভোগ করছেন। (চলবে)

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা

মূল সংস্কার উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহায়তার অঙ্গীকার

মূল সংস্কার উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহায়তার অঙ্গীকার